নারায়ণগঞ্জে গুলিতে শিশু রিয়া গোপের মৃত্যু ছিল আলোচিত

Ashok Kumar
By -
0

নারায়ণগঞ্জে গুলিতে শিশু রিয়া গোপের মৃত্যু ছিল আলোচিত

মাহফুজুর রহমান পারভেজ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

নারায়ণগঞ্জে গুলিতে শিশু রিয়া গোপের মৃত্যু ছিল আলোচিত নারায়ণগঞ্জে গুলিতে শিশু রিয়া গোপের মৃত্যু ছিল আলোচিত

নারায়ণগঞ্জ: নানা ঘটনায় বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল নারায়ণগঞ্জ। রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ঘিরে পুলিশ সদস্যকে পেটানো, বিএনপি নেতার চোখে গুলি আর শামীম ওসমানের সমাবেশ ছিল আলোচিত।

তবে সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গেছে দুটি দিনের ঘটনা। একটি হলো পুলিশের গুলিতে ৬ বছরের এক শিশুর মৃত্যু, আরেকটি হলো স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের দিন জেলাজুড়ে উল্লাস-আনন্দ মিছিল।

 

তবে হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর পর ওসমান পরিবারের সদস্যদের বাড়ি-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুট-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও স্মৃতি হয়ে থাকবে নারায়ণগঞ্জবাসীর হৃদয়ে।

পুলিশের গুলিতে শিশু রিয়া গোপের মৃত্যু ছিল আলোচিত

নারায়ণগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাড়ির ছাদে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপ মারা যায়।

আন্দোলনের সময় ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই বিকেলে শহরের নয়ামাটি এলাকায় বাসার ছাদে খেলছিল শিশু রিয়া গোপ।

এসময় একটি গুলি এসে রিয়ার মাথায় লাগে। পরবর্তীতে তাকে দ্রুত উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পাঁচদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা যায় সে।

এদিকে একমাত্র সন্তানের করুণ মৃত্যুতে পাগলপ্রায় হয়ে পড়েন রিয়ার পরিবারের সদস্যরা।

নিহত শিশু রিয়ার ছবি

নয়ামাটি এলাকায় পাঁচতলা দ্বীনবন্ধু মার্কেটের পঞ্চম তলায় পরিবার নিয়ে থাকেন দীপক কুমার গোপ। দীপক কুমার গোপ ও বিউটি ঘোষ দম্পতির একমাত্র সন্তান ছিল রিয়া। বিয়ের পাঁচ বছর পর এ দম্পতির ঘর আলো করে আসে রিয়া। দেখতে পুতুলের মতো সুন্দর। এ বছরই রিয়া নয়ামাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন রিয়ার বাবা দীপক কুমার গোপ। বাড়ির সামনে খেলাধুলার জায়গা নেই। সেদিনও অন্যান্য দিনের মতো ছাদের খেলছিল রিয়া। হঠাৎ ভবনের নিচে ও চারপাশে হইচই, চিৎকার চেঁচামেচি আর গুলির শব্দ শুনে দৌড়ে ছাদে যান মেয়েকে ঘরে আনতে। মেয়েকে কোলে তুলে নিতেই বুলেট এসে বিদ্ধ হয় রিয়ার মাথায়। মুহূর্তেই ঢলে পড়ে বাবার কোলে।

রক্তে ভিজে যায় পুরে শরীর। দ্রুত রিয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালে। চিকিৎসক অবস্থার অবনতি দেখে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। রাতেই মাথায় অস্ত্রোপচার হয়। সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে বলে জানান চিকিৎসকরা।

রিয়াকে রাখা হয় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। বলা হয়, ৭২ ঘণ্টার আগে কিছু বলা যাবে না। অস্ত্রোপচারের পর শনিবার পার হয়। রোববার ও সোমবার আইসিইউতে একটু একটু করে আঙুল নাড়ছিল রিয়া। স্বজনদের বুকে আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু বুধবার সকালের দিকে রিয়ার সে নড়াচড়াও থেমে যায়। সবাইকে কাঁদিয়ে রিয়া চলে যায় না-ফেরার দেশে।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনে নজিরবিহীন উল্লাস দেখে নারায়ণগঞ্জবাসী

নারায়ণগঞ্জে পাঁচ আগস্টের দিন নজিরবিহীন এক ঘটনার সাক্ষী হয় নারায়ণগঞ্জ। বছরের সবচেয়ে আলোচিত দিন ছিল এটি। ঘটনাবহুল এ দিনে শহরের পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটতে দেখা গেছে।

৫ আগস্ট সকাল থেকে নারায়ণগঞ্জ শহরে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে শহরের চাষাঢ়া ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। রূপায়ণ টাওয়ারে অয়ন ওসমানের কার্যালয়ে সকাল থেকেই জড়ো হতে দেখা গেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের।

সকাল ১০টার দিকে ঢাকার অভিমুখে লংমার্চে যোগ দিতে জড়ে হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে চাষাঢ়া এলাকায় পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বাধে শিক্ষার্থীদের। এসময় চাষাঢ়া গোল চত্বর এলাকা থেকে তিন দিকে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে পুলিশ।

শেখ হাসিনার পতনের খবরে লাখ মানুষ পতাকা হাতে রাস্তায় নেমে আসে

সকাল ১১টার দিকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। এসময় সংঘর্ষে চাষাঢ়া এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

এদিকে দুপুর ১২টার পর থেকে দৃশ্যপট পাল্টে যেতে শুরু করে। দুপুরের আগেই চাষাঢ়া ত্যাগ করে পুলিশ। এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরাও পালাতে বাধ্য হয়। দুপুরে সেনাপ্রধানের জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের খবর পাওয়ার পর শহরের আশপাশের এলাকা থেকে চাষাঢ়ার দিকে লোকজন আসতে শুরু করে।

দুপুর আড়াইটার দিকে খবর ছড়িয়ে পড়ে শেখ হাসিনা পালিয়েছেন। এ সময় পর্যন্ত চাষাঢ়ার আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তবে সরকার পতনের খবর পাওয়ার পর সকলে শহর ত্যাগ করতে থাকেন।

এদিকে সরকারের পতনের খবর পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই চাষাঢ়া এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এসময় জাতীয় পতাকা হাতে বিজয় উল্লাস করতে দেখা গেছে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রায় সকল শ্রেণিপেশার মানুষ এদিন রাজপথে নেমে আসে অদ্ভুত এই বিজয়ের সাক্ষী হতে। রাত পর্যন্ত মানুষের উল্লাস ও আনন্দ মিছিলে মুখরিত থাকে নারায়ণগঞ্জ। স্বাধীনতার পর এমন বিজয় উল্লাস দেখেনি নারায়ণগঞ্জ।

ওসমান পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে লুট ও অগ্নিসংযোগ- অফিস ভাঙচুর 

নারায়ণগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওসমান পরিবারের সদস্যদের বাড়ি ও অফিসে ভাঙচুর চালিয়েছিল বিক্ষুব্ধ জনতা, যা ২০২৪ সালের অন্যতম আলোচিত একটি ঘটনা।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার খবরে নারায়ণগঞ্জের রাজপথে নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ। জাতীয় পতাকা হাতে শহরের এক প্রান্ত থেকে আরে প্রান্ত পর্যন্ত চলে আনন্দ মিছিল। হাসিনার পদত্যাগের খবর বের হওয়ার পরেই ওসমান পরিবারের সদস্যদের বাড়ি ও অফিসে হামলা চালানো হয়।

এসময় শহরের জামতলায় শামীম ওসমানের বাসভবনে ঢুকে সব আসবাবপত্র একে একে নিয়ে যায় হামলাকারীরা। বাড়ির টাইলস জানালার গ্রিলসহ তুলে নিয়ে যায় তারা। এরপর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। চাষাঢ়ায় সেলিম ওসমানের বাড়িতেও ভাঙচুর লুটপাট চালানো হয়। ধরিয়ে দেওয়া হয় আগুন।

ওসমান পরিবারের সদস্যদের বাড়ি ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ

আল্লামা ইকবাল রোডে শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরি ওসমানের অফিসে ও ৭ তলা বাড়িতেও হামলা চালানো হয়। এসময় আজমেরীর অফিস ভাঙচুর করে মালামাল নিয়ে যায় তারা। এসময় গ্যারেজে থাকা ২টি গাড়ি ও ৭ টি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়। তোলারাম কলেজের মোড়ে শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমানের অফিসেও ভাঙচুর চালানো হয়। এসময় সেখান থেকে মালামাল লুটে নেওয়া হয়।

৫ আগস্ট বিকাল থেকে নারায়ণগঞ্জ শহর ছিল লোকে লোকারণ্য। শহরের প্রধান সড়ক বিবি রোডে ৩ কিলোমিটার জুড়ে ছিল এই জনসমাগম।

এর আগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন সময়ে নারায়ণগঞ্জে ছাত্র-জনতার ওপর চালানো হামলাগুলোর নেপথ্যে ছিল ওসমান পরিবারের সদস্যরা।

পাঁচ আগস্ট সকাল পর্যন্ত শহরে তাদের বাড়িঘর অফিসে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ শহরের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের দেখা গেছে। সকালে লংমার্চে যোগ দিতে রওনা দেওয়া ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের পাশে থেকে হামলা চালায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের এসব নেতাকর্মীরা। দুপুর পর্যন্ত চাষাঢ়ায় গুলি ও সংঘর্ষ চলতে থাকে। তবে দুপুরের পর জনতার স্রোত চাষাঢ়ার দিকে আসতে থাকলে তারা পালিয়ে যায়।

বছর শুরু শেখ হাসিনার প্রচারণায়, শেষ হত্যা মামলায়

নারায়ণগঞ্জে ২০২৪ সাল ছিল ঘটনাবহুল একটি বছর। দেশের রাজনীতি ওলট-পালট করে দেওয়া এই বছরের শুরু থেকেই নারায়ণগঞ্জ ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বছরের শুরুতেই নারায়ণগঞ্জে সমাবেশ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ সমাবেশটি ছিল নারায়ণগঞ্জে।

গত ৪ জানুয়ারি শহরের ওসমানী স্টেডিয়ামে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। নারায়ণগঞ্জে এটিই ছিল শেখ হাসিনার শেষ সমাবেশ। এদিকে বছরের শেষ মাস ডিসেম্বর মাসেও জেলার থানাগুলোতে একাধিক হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলা হয় তার বিরুদ্ধে।

সমাবেশে নারায়ণগঞ্জের চারটি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী, নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

ক্ষমতাসীন দলের প্রধান শেখ হাসিনার সমাবেশ হলেও সেদিন নারায়ণগঞ্জ শহরে এক ধরনের নীরবতা দেখা গিয়েছিল। মূলত সমস্ত রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করায় নির্বাচন নিয়ে জনসাধারণের মাঝে খুব একটা উৎসাহ দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে থাকলেও সমাবেশে আশানুরূপ জনসমাগম দেখা যায়নি।

এদিকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার আগে সারা দেশে বিএনপির অন্তত ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। নারায়ণগঞ্জেও বিএনপির বহু নেতাকর্মী আটক হন, বাকিরা ছিলেন আত্মগোপনে। বিরোধী দলগুলোর ওপর এমন নিপীড়নের ফলে জনসাধারণের মাঝে চাপা ক্ষোভ দেখা গেছে সেসময়।

এদিকে শেখ হাসিনার আগমনকে ঘিরে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়া এলাকা থেকে শুরু করে ইসদাইর এলাকা পর্যন্ত সমস্ত দোকানপাট ও ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। সমাবেশস্থলের আশেপাশের বিল্ডিংগুলোর জানালা ও বারান্দায় ছিল প্রশাসনের পাহারা।

শেখ হাসিনার জনসভাকে ঘিরে পুরো শহর ব্যানার ফেস্টুন দিয়ে সাজান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সমাবেশে অংশ নিয়ে সেদিন শেখ হাসিনা বলেন, এখন মানুষ সেবা পাচ্ছে, বাংলাদেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আর বিএনপি সেখানে কী করে, আপনারা দেখেছেন। ২৮ অক্টোবর তারা কী ভয়ংকরভাবে পুলিশের ওপর আক্রমণ করেছে।  

তিনি আরও বলেন, আজকে নির্বাচনে তারা আসেনি, সেটি তাদের ইচ্ছা। কিন্তু মানুষের ভোটের অধিকারে বাধা দেওয়া কখনোই দেশের জনগণ মেনে নেবে না। এ অধিকার মানুষের অধিকার। সুতরাং ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ইনশাআল্লাহ হবে।  

এদিকে এসকল বক্তব্যের পর একই বছরে মানুষ হত্যায় একের পর এক অভিযোগে মামলা হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা কর্মকাণ্ডে অভিযুক্ত হন তিনি। জেলার বিভিন্ন থানায় দায়েরকৃত হত্যা মামলায় তিনি ও তার দলের নেতাকর্মীরা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন বলে অভিযোগ উঠে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৪
এমআরপি/এসএএইচ

 

facebook sharing button

Post a Comment

0Comments

Please Select Embedded Mode To show the Comment System.*